বিটকয়েন কি? বিটকয়েন কিভাবে এল? বিটকয়েন এর ভাল খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

বর্তমানে আলোচনার একটি শিরোনাম হল বিটকয়েন। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এই বিটকয়েন নিয়ে অনেক হইচই করা হয়। সেখানে অনেকে বিটকয়েন এ বিনিয়োগ করে বহু টাকার মালিক হয়ে গেছেন। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলাতে আমাদের বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে জানা উচিত।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হল "বিটকয়েন জিনিসটা কি"। বিটকয়েন এর ভালো-খারাপ দিক নিয়েও আলোচনা করব।

বিটকয়েন কি?

বিটকয়েন মূলত একটি ডিজিটাল কারেন্সি বা ডিজিটাল মূদ্রা। সাধারণত টাকার কাগজি নোট আমরা ব্যবহার করে থাকি। এক সময় স্বর্ণমূদ্রা বা রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করা হত। আবার তারও আগে বিশেষ ধরনের পাথর বা ঝিনুককে টাকা বা মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হত। ঠিক সেরকমই টাকা বা মূদ্রার একটা ডিজিটাল রূপ হচ্ছে বিটকয়েন।

শুধু ডিজিটাল রুপ বললে আসলে ভুল হবে, এটা একপ্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সি। ক্রিপ্টোকারেন্সি হল একপ্রকার গুপ্তমূদ্রা। এর কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এর কার্যক্রম, লেনদেন সবই অনলাইনে হয়। বইয়ের ভাষায় বিটকয়েন হল বিশ্বের সর্বপ্রথম ওপেন-সোর্স ক্রিপ্টোকারেন্সি যা এক প্রকার বিকেন্দ্রিক ডিজিটাল মূদ্রা (উইকিপিডিয়া)।

কি? একটু কঠিন হয়ে গেল? আচ্ছা, সহজ ভাষায় ব্যাখা করছি….

বিটকয়েন বিষয়টা বুঝার আগে আমাদেরকে বুঝতে হবে টাকা বা মূদ্রা জিনিসটা কি? এর ইতিহাসটা কি রকম? মনে করুন একজন লোকের অনেক বড় একটি পুকুর আছে এবং ঐ পুকুরে অনেক মাছ আছে। আর একটা ধানক্ষেত আছে। এখন তার তো আর ধানক্ষেত থেকে আসা চাল আর পুকুরের মাছ দিয়ে চলবেনা। মাছ রান্নার জন্য তেল থেকে শুরু করে আরও অন্যান্য তরিতরকারি লাগবে যেগুলো তার নেই। তারপর চলাফেরার জন্য জামাকাপড় লাগবে।

তো এমন দেখা গেছে যে কারও অনেক পরিমান চাল আছে কিন্তু তরকারি নেই। আবার কারও অনেক পরিমান তরকারি আছে কিন্তু চাল নেই। এখন উপায় কি? যার চাল বেশি সে ঐ লোকটাকে কিছু চাল দিবে এবং বিনিময়ে কিছু তরকারি নিবে। কিন্তু এরকম যদি সবসময় হয় তাহলে সবসময় যার যেই পন্য বেশি তাকে সেই পন্য মাথায় নিয়ে ঘুরতে হবে।

এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রথমে মূল্যবান পাথর বা সামূদ্রিক ঝিনুককে মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার শুরু করা হয়। অর্থাৎ মানুষ নির্দিষ্ট সংখ্যক ঝিনুক বা পাথরের বিনিময়ে পন্য বিনিময় করা শুরু করল। এভাবে এক পর্যায়ে ঝিনুক বা পাথরের পরিবর্তে সোনা বা রুপার ব্যবহার শুরু করল। এভাবে মানুষ স্বর্ণমূদ্রা বা রৌপ্যমূদ্রার যুগে প্রবেশ করল। কিন্তু স্বর্ণমূদ্রা বা রৌপ্যমূদ্রা নিয়েও নতুন ঝামেলা শুরু হতে লাগল।

ব্যবসায়ীক বা যেকোনো প্রয়োজনে প্রচুর পরিমান স্বর্ণমূদ্রা বা রৌপ্যমূদ্রা বহন করাটা ছিল ঝূঁকিপূর্ন। এ সমস্যার সমাধানে আসল ব্যাংক সিস্ট্যাম। কেউ চাইলে তাদের মূদ্রা ব্যাংকে জমা রাখতে পারত এবং ব্যাংক নির্দিষ্ট পরিমান স্বর্ণের বিনিময়ে একটা সার্টিফিকেট প্রদান করত। এই সার্টিফিকেটই ব্যক্তির স্বর্ণের মালিকানার প্রমান ছিল। যখন ঐ লোকটির কোনো পন্যের প্রয়োজন হতো সে ঐ সার্টিফিকেট এর বিনিময়ে পন্য নিতে পারত।

এই সার্টিফিকেটটাই হল টাকা বা মূদ্রা। সেই টাকার মান নির্ভর করত সোনার উপর। কিন্তু পৃথিবীতে সোনার পরিমান নির্দিষ্ট। এছাড়াও সোনার উপর নির্ভরশীল মূদ্রার আরও নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। তারপর প্রথম ব্রিটেন তারপর আমেরিকা সোনার উপর নির্ভরতা থেকে সরে আসে। তারপর অন্যান্য দেশও তাদেরকে অনুসরন করে।

নতুন যে মূদ্রাব্যবস্থা চালু হয় সেটার নাম হল ফিয়াট কারেন্সি। বর্তমানে আমরা যে মূদ্রা ব্যবস্থা রয়েছে সেটি হল ফিয়াট কারেন্সি। এর মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়।

যেহেতু আজকের আলোচনার বিষয় বিটকয়েন তাই আমরা ফিয়াট কারেন্সি নিয়ে বেশি আলোচনা করব না। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি ফিয়াট কারেন্সির নিয়ন্ত্রন থাকে কোনো দেশের সরকারের উপর। কিন্তু বিটকয়েন হল এমন এক মুদ্রা ব্যবস্থা যেখানে এর কোনো নিয়ন্ত্রক নেই। কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক এর মাধ্যমে এর লেনদেন হয় না। অনলাইনে ওপেন সোর্স সফটওয়ার এর মাধ্যমে বিটকয়েন এর সকল লেনদেন সম্পন্ন হয়।

আপনি চাইলে বিটকয়েন মাইনিং করতে পারবেন। বিটকয়েন মাইনিং বলতে বিটকয়েন উৎপাদন বুঝায়। বিটকয়েন মাইনিং এর পর আপনার ওয়ালেটে বিটকয়েন যুক্ত হয়ে যাবে। আপনি অন্য আরেকজনকে বিনিময় হিসেবে বিটকয়েন দিতে পারবেন। এতে যাকে আপনি বিটকয়েন প্রদান করবেন তার বিটকয়েন ওয়ালেটে বিটকয়েন যুক্ত হয়ে যাবে।

এতে ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে পিয়ার টু পিয়ার মাহ্যম ব্যবহার করা হয়। ব্লকচেইন ব্যবহারের কারনে বিটকয়েন চুরি বা হ্যাক খুব কষ্টসাধ্য একটি ব্যপার।

বর্তমানে বিটকয়েন এর জনপ্রিয়তা এত বেশি যে উইকিপিডিয়া, মাইক্রোসফট, গুগল, ওয়ার্ডপ্রেস এর মাধ্যমে বিনিময় করে থাকে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েক হাজার বিটকয়েন এর এটিএম বুথ রয়েছে।

কিভাবে এল বিটকয়েন?

সাতোশি নাকামোতো নামক কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিটকয়েন এর জনক বলা হয়। বিটকয়েন এর প্রচলন শুরু হয় ২০০৯ সালে। এর আগে ২০০৮ সালের ১৮ই আগস্ট bitcoin.org নামক ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করা হয়। ঐ বছরের নভেম্বরেই metzdowd.com নামক ওয়েবসাইটে বিটকয়েন কি এবং তা কিভাবে কাজ করে সেটা প্রকাশ করেন সাতোশি নাকামোতো।

তারপর বিটকয়েন এর সোর্সকোড উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিটকয়েন প্রকাশের প্রথম বছরেই সাতোশি প্রায় এক মিলিয়ন বিটকয়েন মাইন করেন। তারপর ২০১০ সালে বিটকয়েন এর নেটওয়ার্ক কি এবং বিটকয়েন কোর এর রিপজিটরির কোড অপর এক সফটওয়ার ডেভেলপার Gavin Andresen এর কাছে দেন। কিন্তু সাতাশি নাকামোতো সম্পর্কে পরে আর কিছু জানা যায়নি।

বাংলাদেশে বিটকয়েন বৈধ কিনা

এখনও অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিটকয়েন অবৈধ। বিশ্বে বিটকয়েন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার শুরুতেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক বিটকয়েন লেনদেনকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। টাকা পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, ট্যাক্স ফাঁকি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।

তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ সরকার বিটকয়েনকে বৈধতা দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। বিশ্বের প্রায় সকল উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ ইতিমধ্যে বিটকয়েনকে বৈধতা প্রদান করছে। যুগের সাথে তাল মিলাতে বিটকয়েন নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে বৈধতা দিলে তার আগে অবশ্যই কিছু নিতিমালা থাকবে।

বিটকয়েনের ভালো খারাপ দিক গুলো

সবকিছুরই যেমন ভালো দিক থাকে এর বিপরিতটাও থাকে। মুদ্রার ডিজিটাল রূপ হচ্ছে ক্রিপ্টোপারেন্সি। আর বিটকয়েন হল এক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি এর নাম। এই মুদ্রাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল আপনার লেনদেন সম্পর্কে কেউ নজরদারি করতে পারবে না। আর লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য তৃতীয় কারও প্রয়োজন হয় না।

ডিজিটাল কারেন্সি হওয়ার কারনে চুরি বা ডাকাতির থেকে রেহাই মিলবে। তাছাড়া এটি ব্লক চেইন সিস্টেম হওয়ার কারনে হ্যাক থেকেও রেহাই মিলবে।

এবার আসি মূদ্রার অপর পাশ নিয়ে। বিটকয়েন এর মাধ্যমে সিক্রেটলি লেনদেন করা যায় তাই এর মাধ্যমে সন্ত্রাসি কার্যক্রমে বিনিয়োগ, মাদক এর জন্য লেনদেন করা হয়ে থাকে। তাছাড়া এই লেনদেনের তথ্য সারকারের কাছে না যাওয়ার কারনে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া যায়। আরও বড় সমস্যা হল এর মূল্য স্ফিতি। গত কয়েক বছড়ে এর দাম বহুগুন বেড়েছে। বর্তমানে এক বিটকয়েন এর দাম ৪০৮৩৭৫৩.৭১ টাকার মত। এর দাম দিন দিন বেড়েই চলছে।

ধারনা করা হচ্ছে এর দাম এক পর্যায়ে কমতে শুরু করবে। এবং একসময় মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এর বিপরিতটাও হতে পারে। তাই বলা যায় বিটকয়েন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া ব্যবসায়িক কার্যক্রমে এর ব্যবহার খুব বেশি প্রচলিত হয়নি।  

বিটকয়েন এর আরেকটি সীমাবদ্ধতা হল এটি সীমিত। ২১৪০ সাল পর্যন্ত ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন মাইনিং করা যাবে।

বিটকয়েন এর প্রতিদ্বন্দি

বর্তমানে পৃথিবীতে হাজারের উপর ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল বিটকয়েন। অন্যান্যগুলো হল ডোজকয়েন, ইথেরিয়াম, ড্যাশ, রিপল, মোনেরো, লাইটকয়েন, বাইটকয়েন ইত্যাদি। আজকের আলোচনা নিয়ে কোন প্রশ্ন বা মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট এ জানাবেন।

ধন্যবাদ।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments
Ahmad Raihan - Oct 5, 2021, 1:22 AM - Add Reply

ধন্যবাদ

You must be logged in to post a comment.

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ

Higher Secondary Certificate examinee