বাংলার ইতিহাস ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সংক্ষিপ্ত জীবন কথা?

বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের নাতি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাব আলীবর্দী খানের ছিল তিনটি মেয়ে। কোন পুত্র সন্তান ছিল না।

আমাদের চ্যানেলটি সাবসক্রাইব করুন

তিন মেয়ে যথাক্রমে ঘসিটে বেগম, শাহ বেগম এবং ছোট মেয়ে আমেনা বেগম নবাব আলীবর্দী খানের আপন বড় ভাই এর তিনটি ছেলের সঙ্গে তাদের বিয়ে দেন।

ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের ছেলে ছিলেন মির্জা আহমদ ওরফে সিরাজউদ্দৌলা এবং আর এক ছেলের নাম ছিল মির্জা মেহেদী।

নবাব আলীবর্দী খান যখন পাটনার শাসনভার গ্রহণ করেন তখন তার ছোট কন্যা আমেনার গর্ভ থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। এ কারণে নবাব আলীবর্দী খান তার দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে সবচাইতে বেশি ভালবাসতেন।

নবাব আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি তার নাতিকে লালন পালন করেন। ছোটবেলা থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার মাতামহের কাছে লালিত পালিত হয়ে বড় হন।

সিরাজউদ্দৌলার সঠিক জন্ম তারিখ জানা না থাকলেও ধারণা করা হয় ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৪৭ সালে যখন মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যান তখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নবাব আলীবর্দী খানের সাথী হন। বালক বয়সেই নবাব তার নাতি সিরাজউদ্দৌলাকে পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

কিন্তু তার বয়স কম বিদায় রাজা জানকীরামকে  পাটনার রাজ প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। বিষয়টি সিরাজউদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

তাই তিনি একদিন গোপনে তার বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে পাটনায় গিয়ে উপস্থিত হন। এবং জানকীরামকে শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদেশ করেন।

কিন্তু রাজা জানকীরাম নবাবের অনুমতি ছাড়া ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

দুর্গের দ্বার বন্ধ করে খাজা জানকীরাম বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী খানের কাছে দুত পাঠান। এদিকে সিরাজউদ্দৌলা রাজা জানকীরামের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে দুর্গ আক্রমণ করেন।

দুপক্ষের মধ্যে লড়াই হয় এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটে।

ঘটনা শুনে আলীবর্দি খান দ্রুত ঘটনাস্থলে আসেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সেদিনই আলীবর্দি খান দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে বসে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন যে, 

"আমার পরে সিরাজউদ্দৌলাই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে বসবে।"

কিন্তু সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের ঘোষণা তার আত্মীয় বর্গের মাঝে অনেকে মেনে নিতে পারেন নি।

তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তার আত্মীয়-বর্গের অনেকেই এর বিরোধীতা শুরু করল। এর মধ্যে আলীবর্দী খানের বড় জামাতা নোয়াজেশ মোহাম্মাদ এবং বড় মেয়ে ঘোসেটি বেগম ছিলেন অন্যতম।

১৭৪০ সাল থেকে ১৭৪৪ সাল পর্যন্ত নবাব আলীবর্দী খানের ভাতুষ্পুত্র এবং তার বড় জামাতা নোয়াজেশ মোহাম্মাদ খান ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হন।

তবে তিনি নায়েব নাজিম নিযুক্ত হওয়ার পর মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তার সহকারী হোসেন কুলি খান এবং হোসেন কুলি খানের সহকারী হোসেন উদ্দিন খানকে ঢাকার দায়িত্ব পালন করান ১৭৪৪ সাল থেকে ১৭৫৪ সাল পর্যন্ত।

সে সময় থেকেই আলীবর্দি খানের আরেক ভাতুষ্পুত্র শওকতজং ও নোয়াজেশ মোহাম্মাদের সাথে বিরোধ দেখা দেয়। সেই বিরোধের জেরে মুর্শিদাবাদে তদীয় চাচা এবং ঢাকায় হোসেন উদ্দিন খান নিহত হন।

হোসেন উদ্দিন খানের হত্যায় জড়িত ছিল বাকেরগঞ্জের জমিদার আগা বাখের ও তার পুত্র আগা সাদেক।

হোসেন উদ্দিন খানের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগা সাদেক মুর্শিদাবাদে হোসেন কুলি খান কর্তৃক বন্দি হন। সেখান থেকে সে ঢাকায় পালিয়ে এসে হোসেন কুলি খানকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

হোসেন কুলি খান ছিলেন নোয়াজশের ধনভান্ডারের দায়িত্বে। অত্যন্ত সৎ এবং ধার্মিক হোসেন কুলি খানকে রাতের অন্ধকারে তার বাসভবনে ঢুকে তাকে হত্যা করে। 

সকাল বেলা ঘটনাটি জানাজানি হলে শহরের অধিবাসী আগা বাখের ও আগা সাদেককে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে। তারা ঢাকার নায়েব নাজিম নিযুক্ত হতে এসেছে বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করে।

শহরের লোকজন সনদপত্র প্রদর্শন করতে বললে তারা তা দেখাতে না পেরে তরবারি উত্তোলন করে। এ পরিস্থিতিতে জনতার আক্রমণে আগা বাখের ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় এবং আগা সাদেক প্রচন্ড আহত হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

নয়াযেশ এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল হোসেন কুলি খান ও রাজ বল্লব। হোসেন কুলি খার মৃত্যুতে রাজবল্লভ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।

নোয়াজেশ নিঃসন্তান ছিলেন বলে সিরাজউদ্দৌলার ছোট ভাই মীর্জা মেহেদীকে পূষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন। তবে মীর্জা মেহেদী নোয়াজেশের জীবদ্দশায়ই মারা যান।

কিন্তু তিনি অল্প বয়স্ক একটি পুত্র সন্তান রেখে যান। এই সুযোগে রাজবল্লভ ষরযন্ত্র পরিকল্পনা শুরু করেন। তিনি সেই ছেলেটিকে সিংহাসনে বসিয়ে তার মাতামহ ঘসেটি বেগমের নামে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবী করার স্বপ্ন দেখছেন।

চারিদিকে প্রচন্ড অরাজকতা ও ষরযন্ত্র শুরু হয়। ইংরেজরা নবাবের বীনা অনুমতিতে কলকাতায় দুর্গ সংস্কার কাজ শুরু করে।

রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তার জন্য ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ নিজ পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠান।

এরকম দুর্যোগ পরিস্থিতির মধ্যেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন। আর ঐ দিনই মীর্জা মোহাম্মদ জং বাহাদুর সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করেন।

সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই ইংরেজদের প্রতাপ আরো বাড়তে থাকে। তাদের দমন করার জন্য তিনি কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে আদেশ করেন।

এবং ভবিষ্যতে তার অনুমতি ছাড়া এরকম কাজ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু তারা নবাবের কথা অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারলেন, গৃহযুদ্ধের সুযোগে ইংরেজরা তাদের উদ্ধত ভাব প্রকাশ করছে। তাই তিনি ঘসেটি বেগমের চক্রান্তকে চুর্ণ করে দেবার জন্য সচেষ্ট হন।

তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদ আনার ব্যবস্থা করেন।

২৭, মে নবাবের সেনারা কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ করেন। তিনি কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে তার দরবারে হাজির হয়ে তার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য করেন।

১৮ জুন সিরাজউদ্দৌলা কলকাতার দুর্গ আক্রমণ করেন। তমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতার দুর্গ নবাবের দখলে আসে। নবাব দুর্গে প্রবেশ করে এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাদ ও কৃষ্ণবল্লভকে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। 

সেনাপতি মানিকচাদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে তিনি ১২ জুলাই রাজধানী প্রত্যাবর্তন করেন।

এদিকে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জং এর সিরাজউদ্দৌলার সাথে যুদ্ধ যাত্রার ঘোষণা দেওয়ার কথা শুনে ইংরেজরা শওকত জং এর সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করে।

অপরদিকে মাদ্রাজের ইংরেজ দরবার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে কলকাতা উদ্ধারের জন্য পাঠায়।

সিরাজউদ্দৌলা শওকত জংকে প্রতিহত করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে উভয়পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষে শওকত জং নিহত হন। সিরাজউদ্দৌলা মোহনলালকে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতা অভিমুখে রওয়ানা হয়। প্রায় বীনা বাঁধায় তারা কলকাতা দুর্গ জয় করে নেয়। এর আগে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায় এসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছে সন্ধি প্রস্তাব পাঠায় এবং নবাব তাতে রাজি হন। 

সিরাজউদ্দৌলা তার মন্ত্রীদের কুচক্রের ব্যাপারে শঙ্কিত হন। এ কারণে তিনি ইংরেজদের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।

তাই ইংরেজদের সকল দাবিতে রাজি হয়ে ১৭৫৭ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি আলিনগরে ইংরেজদের সাথে একটি সন্ধিপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেন।

এই সন্ধির প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য নবাবকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এটিই আলীনগর সন্ধি নামে পরিচিত।

কিন্তু ইংরেজদের মতিগতির কোন পরিবর্তন ঘটল না। তারা শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমণ করল। মূলত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা  ছিল ফরাসিদের সাথে। নবাব ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিতেন।

গোলমাল নিয়ন্ত্রণে আনার পর সিরাজউদ্দৌলা কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার কার্য শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীর জাফর ভীত হয়ে যায়।

এরপর তারা জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে একত্রিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যূত করে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসানোর জন্য ইংরেজদের সাহায্যের পরিকল্পনা শুরু করে।

ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে দেখা করে কুমন্ত্রণা দিল যে, শিঘ্রই সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার পরিকল্পনা করছে। এজন্য তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন।

ক্লাইভ তার অর্ধেক সেনা লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতা অভিমুখে রওনা হল। কলকাতায় পৌঁছে নবাবকে পত্র লিখল, "আমরা সেনা উঠিয়ে আনলাম, আর আপনি পলাশীতে ছাউনী গেড়ে বসেছেন?"

নবাব সরল বিশ্বাসে পলাশী থেকে ছাউনী উঠিয়ে মীর জাফরকে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার আদেশ করলেন। মীর জাফর মুর্শিদাবাদ চলে যাবার পর স্ক্রাফটন তার সাথে মিলিত হয় গোপন সন্ধির খসরা তৈরি করল।

১৭ ই মে কলকাতায় ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধির খসরা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবং মীর জাফরের স্বাক্ষরের জন্য ১০ জুন গোপন সন্ধিপত্র তার কাছে পাঠানো হয়।

১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সেনারা চন্দননগরের সেনবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে সেখানকার দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সেনা মোতায়েন করে বাকি সবাই যুদ্ধযাত্রা শুরু করল।

কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সেনা মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের বাধা দেয়নি। সিরাজউদ্দৌলার বুঝতে বাকী রইল না সেনাপতিরাও এই ষরযন্ত্রের সাথে জড়িত।

নবাব বিদ্রোহের আবাস পেয়ে মীর জাফরকে বন্দী না করে তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং শপথ নিতে বললেন। মীর জাফর পবিত্র কোরআন শরীফ স্পর্শ করে বলল, "আমার গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে আমি বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন হতে দেব না।"

গৃহবিবাদ মিমাংসা করে নবাব সেনাপতিদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করলেন।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। ইংরেজরা সকাল থেকেই মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য পলাশীর প্রান্তরে প্রস্তুত হলো। তারা লক্ষবাগ নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করেছিল।

বেলা আটটার সময় হঠাৎ করে মীর মদন ইংরেজ বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করেন। মীর মদনের তুমুল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সৈন্যদের নিয়ে আম বাগানে আশ্রয় নেয়।

মীর মদন ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হন। ক্লাইভ বিচলিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিল সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

হয়তো তাদের সামান্য সহযোগিতা পেলে মীর মদন ইংরেজদের পরাজিত করতে পারত। দুপুরে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়।

তবু সাহসী মীর মদন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ প্রতিপক্ষের গুলিতে মীর মদন জমিতে লুটিয়ে পড়েন।

মীর মদনের মৃত্যুর পরেও ওন্যতম সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন।

মীর জাফর আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সৈন্যদের শিবিরে‌ ফেরার নির্দেশ দেয়। এই সুযোগে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমণ করে।

বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত যুদ্ধ হওয়ার পর নবাবের ছাউনী ইংরেজদের দখলে চলে আসে। ১৬ জন দেশীয় এবং ৭ জন ইউরোপীয় সৈন্য ইংরেজদের পক্ষে নিহত হয়।

কোন উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা হন। কিন্তু রাজধানী রক্ষার ব্যাপারে কেউ তাকে সাহায্য করেনি।

উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে যান। ভগবান গোলায় পৌঁছে সেখান থেকে নৌকা যোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা করেন।

তার আশা ছিল পশ্চিম তীরে পৌঁছতে পারলে সেখান থেকে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাস এর সহযোগিতায় পাটনায় পৌঁছবেন।

আর পাটনায় পৌঁছতে পারলে রামনারায়নের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।

মীর জাফর রাজধানীতে ফিরে এসে নবাবকে না দেখে চারিদিকে লোক পাঠায়।

৩ জুলাই সিরাজউদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে হঠাৎ করে জোয়ার ভাটার কারণে পানি কমে গেলে নাজিমপুরের মহনায় এসে তার নৌকা চড়ায় আটকে যায়।

সিরাজউদ্দৌলা খাবারের সন্ধানে একটি মসজিদের কাছে বাজারে যান। সেখানে কিছু লোক নবাবকে চিনতে পেরে মীর জাফরের সেনাবাহিনীকে খবর দেয়। তারা এসে নবাবকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়।

এসময় নবাবের সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম ও চার বছরের ছোট শিশু কন্যা উম্মে জহুরা। পরের দিন ৪ জুলাই মতান্তরে ৩ জুলাই মীর জাফরের আদেশে‌ তার ছেলে মীরনের নেতৃত্বে মহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক তাঁকে হত্যা করে।

সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর মীর জাফর ও মীরন সিরাজের মা আমেনা বেগম, তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও শিশু কন্যা সহ পরিবারের সদস্যদেরকে কয়েকটি নিকৃষ্ট নৌকায় উঠিয়ে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে তাঁদেরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়।

সিরাজের হত্যার পূর্ব পর্যন্ত ষরযন্ত্রকারীরা ঘসেটি বেগমকে ব্যাবহার করলেও সিরাজের পতনের পর তাকে কেউ মূল্য দেয় নি। 

সিরাজের পরিবারকে ঢাকায় পাঠানোর কিছুদিন পর মীরন জাহাঙ্গীর নগরের শাসণকর্তা ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি যশরথ খানকে চিঠি লিখে হতভাগ্য বয়স্কা মহিলা ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে হত্যা করার আদেশ দেয়।

এই সদাচারণ শাসণকর্তা ঐ মহিলাদের ও তাদের স্বামীদের কাছে তার উন্নতি ও অন্নের জন্য ঋনী ছিলেন। তাই তিনি মীরনের ঘৃণিত নির্দেশ মানতে অসম্মতি জানান।

ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখার পর ঘসেটি বেগম এবং সিরাজউদ্দৌলার মা আমেনা বেগমকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়।

ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেসা, সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা ও শিশু কন্যা উম্মে জহুরা রক্ষা পান। পরবর্তীতে তাঁদেরকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়।

ইংরেজ কোম্পানী সরকার কর্তৃক সামান্য বৃত্তির উপর নির্ভর করে তাঁদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর প্রায় দীর্ঘ ৩৩ বছর পর তার বিবি লুৎফুন্নেসা ১৭৯০ সালে মারা যান।

এভাবেই বাংলা স্বাধীনতা হারিয়ে প্রায় ১৯০ বছর ইংরেজদের হাতে শোষিত হয়।

সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বের সমাপ্তি বাংলার স্বায়ত্বশাসনের অবসান ঘটায় এবং ভারতে বৃটিশ শাসনের সূচনা ঘটে। তার শাসনের শেষের সংস্করণে মীর জাফর ও রবার্ট ক্লাইভ ছিল ভিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা ছিল শিকার।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন যখন শক্তিশালী হয় তখন সিরাজউদ্দৌলা, টিপু সুলতান, শেষ মোঘল সম্রাট এবং দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ভারতীয় স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের নায়ক।

যারা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিরোধকারী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশে তাকে শেষ বৈধ শাসক হিসেবে গণ্য করা হয়।

Enjoyed this article? Stay informed by joining our newsletter!

Comments

You must be logged in to post a comment.

Related Articles
লেখক সম্পর্কেঃ